| Sign-Up

জয় বাংলা - বাংলার জয়। জয় বাংলা ৭১ (একাত্তর) www.JoyBangla71.com পোর্টালে আপনিও কলাম ও সংবাদ প্রকাশ করতে পারবেন। আপনার এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রকাশ করতে পারবেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের সব চেয়ে নির্মম অবস্থা বর্তমান সাংবাদিকতা। তাই আপনার এলাকার সংবাদ আপনি নিজেই প্রকাশ করুন।

কলাম

অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী : এক জীবন্ত ইতিহাস।

অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী—বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির ইতিহাসে এমন এক নাম, যিনি ছিলেন সাহস, সততা ও ত্যাগের প্রতীক। তাঁর জন্ম ১৯৪২ সালের ৩০ জুন। ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে যে যাত্রা শুরু করেন, তা পরিণত হয় এক কিংবদন্তি রাজনৈতিক জীবনের মহাকাব্যে। ১৯৬১-৬২ শিক্ষাবর্ষে ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তিনি নারীর নেতৃত্বের পথ উন্মুক্ত করেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে তিনি ইতিহাসে স্থান করে নেন প্রথম সারির নারী ছাত্রনেত্রী হিসেবে।

ষাটের দশকের উত্তাল প্রগতিশীল আন্দোলনে মতিয়া চৌধুরী ছিলেন অন্যতম সামনের কাতারের নেতা। ১৯৬৫ সালে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন, তখন ছাত্র ইউনিয়ন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠনগুলোর একটি। শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনের প্রতি তাঁর নির্ভীক সমর্থন তাঁকে এনে দেয় ছাত্রসমাজের গভীর আস্থা ও ভালোবাসা। ১৯৬৭ সালে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতার কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং ময়মনসিংহ কারাগারে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে আটক রাখা হয়। সেই থেকেই তিনি পান “অগ্নিকন্যা” উপাধি—যা সারাজীবন তাঁর পরিচয়ের অংশ হয়ে থাকে।

১৯৬৭ সালে তিনি যোগ দেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-মোজাফফর)-এ, যা ছিল মস্কোপন্থী ও মুক্তিকামী রাজনীতির ধারক। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ও মুজিবনগর সরকারের প্রতি ন্যাপ-মোজাফফরের সুস্পষ্ট সমর্থনের কারণে মতিয়া চৌধুরীর রাজনৈতিক পথ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পরিপূরক হয়েই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর সংগঠক। ত্রিপুরা ও আসামের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আহত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি পালন করেন মানবিক দায়িত্বের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে মতিয়া চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারী। তিনি প্রকাশ্যে ন্যাপের রাজনীতিতে থাকলেও ১৯৭৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন—যে সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে। বঙ্গবন্ধু তাঁর যোগ্যতার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন ১৯৭৫ সালে গঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)-এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে।

জিয়াউর রহমানের সময় যখন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ‘১৯ দফা কর্মসূচী’ ঘোষণা করেন, মতিয়া চৌধুরী তাতে সম্মত হননি। তিনি তখনই বুঝেছিলেন, জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথে আপস নয়—এই বিশ্বাস থেকেই ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর ১৭ জন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে ন্যাপ ত্যাগ করে যোগ দেন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে।

১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর মতিয়া চৌধুরী হয়ে ওঠেন তাঁর অগ্রণী সহচর। পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন, প্রতিটি সংগ্রামে তিনি ছিলেন শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত সহযাত্রী। শেরপুর থেকে পরপর ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া, দুই দফায় কৃষিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ—সবই তাঁর প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক নৈতিকতার সাক্ষ্য বহন করে।

তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন সময়ে তাঁকে নিয়ে প্রচার করা হয়েছে নানা অপপ্রচার, যার মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল “বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাবেন” — এই ভুয়া গল্প। কিন্তু ইতিহাস ও প্রমাণ বলছে, এমন কোনো ঘটনার কোনো ভিত্তিই নেই। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় কিংবা পরবর্তী সময়ে মতিয়া চৌধুরী কখনোই তাঁর বিরোধিতা করেননি; বরং তাঁর আদর্শেই রাজনীতি করেছেন সারাটি জীবন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তাঁর ভূমিকা সেই সত্যকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে।

২০২৪ সালের এই দিনে, তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হন। তাঁর মতো নেত্রীর মৃত্যুর পরও রাষ্ট্র তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দেয়নি—মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি শায়িত হন তাঁর প্রিয় স্বামী, প্রখ্যাত সাংবাদিক বজলুর রহমানের কবরেই।

অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী শুধু একজন রাজনীতিক নন—তিনি বাংলাদেশের নারী নেতৃত্বের প্রতীক, সংগ্রামী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা, এবং এক অগ্নিশিখা যিনি সারাজীবন জ্বলে উঠেছেন ন্যায়, গণতন্ত্র ও মানবতার পক্ষে।

মতিয়া চৌধুরীরা বারবার জন্মায় না। তাঁদের ইতিহাস লেখা যায় না ছোট পরিসরে; তাঁদের ইতিহাসই বাংলাদেশের প্রগতির ইতিহাস।”

বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা 🖤🙏
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

মন্তব্য করুন